ভারতের আধুনিক কালের ইতিহাসের উপাদান
আধুনিক ইতিহাস লেখার জন্য উপাদান ও নানারকম । বর্তমানে তুলনায় আধুনিক ইতিহাসের সময়টা অনেক কাছাকাছি বলে বিভিন্ন উপাদান এখনও হাতের কাছে পাওয়া যায় । গত চার-পাচশো বছরের কাগজপত্র, বই, আঁকা ছবি এখনো ততটা নষ্ট হয়নি। তাছাড়া না না বৈজ্ঞানিক উপায়ে সেই সব উপাদানকে রক্ষণাবেক্ষণ করার ব্যবস্থা করা গেছে। সব মিলিয়ে পৃথিবী জুড়ে এই আধুনিক সময়ের ইতিহাস লেখার উপাদানের বৈচিত্র্য অনেক বেশি । ভারত-ইতিহাস ও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রশাসনিক কাগজপত্র সবই ইতিহাসের উপাদান। আবার ছবি, মানচিত্র, পোস্টার, বিজ্ঞাপন, সংবাদপত্র _ কত রকমের জিনিস ব্যবহার করা হয়? ইতিহাস লেখার কাজে ।
তবে বিভিন্ন উপাদান বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতে হয় । ধরা যাক কারো আত্মজীবন থেকে আর সময়ের ইতিহাস উপাদান পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সোজাসুজি সেই আত্মজীবনী ব্যবহার করলেই হবে না। কারণ, জিনিয়া আত্মজীবনী লিখেছেন, তিনি তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচারধারা থেকে সবকিছু ব্যাখ্যা করেছেন । ঐতিহাসিক যাই বক্তব্য। কখনোবা পুরো ভুল সিদ্ধান্তেও পৌঁছে যেতে পারেন ঐতিহাসিক । যেমন, উইলিয়ম ওয়েডারবার্ন তার লেখা এলেন অক্টোভিয়ান হিউমের জীবনীতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব হিউমকেই দিয়েছেন । অথচ পরে দেখা গেছে যতটা কৃতিত্ব হিউমকে দেওয়া হয়, আদৌ ততটা কৃতিত্বের দাবিদার হিউম নন। ঐতিহাসিক যদি শুধু ওয়েডারবার্নের কথায় মেনে নিতেন, তাহলে এই নতুন বিশ্লেষণ পাওয়া যেত না । অর্থাৎ, সমস্ত উপাদানকে প্রশ্ন করে খুঁজিয়ে ভেঙেচুরে দেখতে হয় ঐতিহাসিককে ।
ভারত-ইতিহাসের আধুনিক পূর্বের বিষয়ে জানার অন্যতম উপাদান ফটোগ্রাফ অর্থাৎ ক্যামেরায় তোলা ছবি । এইরকম ছবির অনেক সংগ্রহ থেকে সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক কিছু জানা যায় । তবে ফটোগ্রাফগুলি ও পুরোপুরি নৈর্ব্যক্তিক নয় । মানে আত্মজীবনী বা জীবনের ক্ষেত্রে লেখক নিজের ইচ্ছামত লিখতে পারেন । তেমনি ছবি যিনি তুলছেন, তার দেখার উপরেই ক্যামেরার দেখা নির্ভর করে । ফলে একই বিষয়ের দু-জনের তোলা দুটি ছবি দু-রকমের অর্থ দাঁড়াতে পারে ।
উপরের ছবিটা 1938 খ্রিস্টাব্দের হরিপুর কংগ্রেস অধিবেশনের সময় তোলা একটি ফটোগ্রাফ । অথচ ওই সময়ে নানা প্রসঙ্গের দুজনের মধ্যে মতবিরোধ ছিল । এমনকি পরের বছর সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস - সভাপতির পথ ত্যাগ করেছিলেন । অথচ এই ছবি থেকে সেই সময় ওই দুজনের সম্পর্কের সংঘাত বোঝা যায় না । ফলে ফটোগ্রাফের পিছনের ইতিহাস জানা না থাকলে ফটোগ্রাফ নিজে সব সময় ঠিক মনোভাব প্রতিফলিত করে না ।
প্রশাসনিক নথিপত্রের ক্ষেত্রেও এই দেখার পার্থক্যটা বড় হয়ে দাঁড়ায় । যেমন, ব্রিটিশ সরকারের চোখে বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহ-আন্দোলন গুলি প্রায়শই 'হাঙ্গামা' বা উৎপাত বলে ধরা পড়েছে ধরা পড়েছে । তাদের লেখা সরকারি নথিপত্রেও তেমনি বিশ্লেষণ চোখে পড়বে । অথচ ওই আন্দোলন গুলি ভারতে উপনিবেশিক শক্তি-বিরোধী আন্দোলন হিসেবে দেখলে সেগুলি অন্য মাত্রা চোখে পড়বে । তখন তিতুমীর, বিরসা মুন্ডা, সিধু-কানু-রা কোন অংশেই আর 'হাঙ্গামা' কারী নন, বরং স্বাধীনতা সংগ্রামী ।
এর থেকে যেটা বোঝা যাচ্ছে যে, ইতিহাসকে দেখা বা বিশ্লেষণ করাটা নির্ভর করে দেখার ও বোঝার ভঙ্গিগর উপরে । আর সেই দেখার ও বোঝার ভঙ্গিগর সঙ্গে জড়িয়ে থেকে থাকে নানা কিছু । সেইসবের মধ্য সাম্রাজ্যের স্বার্থ, উপনিবেশ বিস্তারের আগ্রহ বা জাতীয়তাবাদের আদর্শ থেকে পারে । তাহলে বোঝা দরকার সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও জাতীতায়বাদ কাকে বলে ।
সাম্রাজ্যবাদ একটি প্রক্রিয়া । সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে একটি শক্তিমান দেশ অথবা রাষ্ট্র আরেকটি তুলনায় দুর্বল দেশ অথবা রাষ্ট্রের উপর প্রভুত্ব কায়েম করে তাকে নিজের দলে আনে । দুর্বল দেশটির অথবা রাষ্ট্রের জনগণ, সম্পদ সবকিছুকেই শক্তিমান দেশ অথবা রাষ্ট্রটি নিজের প্রয়োজনমতো পরিচালনা করে । এর ফলে শক্তিমান যখন তার অধীন দুর্বলের ইতিহাস খুঁজতে যায় তখন জেমস মিলের মতো পরিস্থিতি হয় । দুর্বলের ইতিহাস কে কেবল খাটো করে দেখার প্রবর্তক থাকে । বলা শুরু হয়, দুর্বল শুধু দুর্বল নয়, অসভ্যও তাই তার ইতিহাস নেই । কারণ ইতিহাস কেবল সভ্য মানুষের হয় । ফলে ইতিহাসহীন অসভ্য মানুষগুলো যাতে সভ্য হয়ে উঠতে পারে, তার জন্য তাদের সাম্রাজ্যের মধ্যেই রেখে দেওয়া ভালো ।
সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে উপনিবেশবাদের যোগাযোগ স্পষ্ট । ধরা যাক ভারতের অর্থনীতি এক সময়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্বার্থ মোতাবেক চলতো । বাংলায় নীল চাষ করা হতো ইংল্যান্ডের কাপড় কলে নীলের চাহিদা মাথায় রেখে । তাতে করে বাংলার ধান, পার্ট, প্রকৃতি চাষ নষ্ট হতো । বাংলায় অনাহার, দুর্ভিক্ষ দেখা দিত । এই যে একটি অঞ্চলের জনগণ ও সম্পদকে অন্য একটি অঞ্চলের স্বার্থে ব্যবহার করা এটাই উপনিবেশেরও মূল কথা । বৃটেনের উপনিবেশ হিসাবে ভারতের কৃষিজ ফসল বৃটেনের স্বার্থে উৎপাদন হবে ।
সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারার বিরুদ্ধে ভারতের শিক্ষিত জনগণ ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে জোট বাঁধলেন । ইংরেজি শিক্ষা, ও সরকারি চাকরি পেলেও দেশীয় সমাজে শিক্ষিত জনগণ নিজেদের মতো করে নিজেদের দাবিগুলি নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন । সেই চর্চা থেকে ইতিহাস ও বাদ পরলো না । মিলের ইতিহাসের যুক্তিকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্লেষণের বিপক্ষে ব্যবহার করা শুরু হলো । খোঁজা হল প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, মধ্যযুগের ইতিহাস । দেখা গেল যেভাবে ব্রিটিশরা বলে ভারতের ইতিহাস নেই, তা ঠিক নয় । ইতিহাস আছে, শুধু বিভিন্ন উপাদান থেকে তাকে চেহেরা দিতে হবে ।
সেই যে বঙ্কিম বলেছিলেন, আমি, তুমি সবাই ইতিহাস লিখব; সেই কাজটা শুরু হয়ে গেল ।
দেশের মানুষ যখন দেশের ইতিহাস লিখছিলেন, তখন বিভিন্ন ঘটনার অন্য বিশ্লেষণ হাজির হলো । সাম্রাজ্যর স্বার্থের উল্টো দিকে দেশের চিন্তা ও ইতিহাসে জায়গা পেতে শুরু করল । সিরাজ উদ-দৌলা নিরীহ ব্রিটিশ কর্মচারীদের হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ তুলেছিলেন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক । ভারতীয় ঐতিহাসিক অংক কোষে, যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে দিলেন সেই অভিযোগ মিথ্যা । ইতিহাসের মধ্যে ঢুকে পড়ল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দেশীয় তথা জাতীয়তাবাদী বিশ্লেষণের দ্বন্দ্ব ।
আগামী এক বছরে ইতিহাস ও তথ্য, তত্ত্ব, ধারণার পাশাপাশি এই দ্বন্দ্বকগুলি ও চোখে পড়বে। এই বইয়ের নানা স্তরে । তার সঙ্গে প্রায় ২৫০ বছরের কাল পূর্বে কিভাবে বদলে গেল ভারতের সমাজ, রাজনৈতিক, সংস্কৃতি, ও মানুষের জীবনযাত্রা তার হদিস ও পাওয়া যাবে । আস্তে আস্তে দেখা যাবে, ইতিহাস যেন তার দূরে থাকছে না । ঢুকে পড়ছে ছুঁয়ে যাচ্ছে বর্তমানকেও । পরিবারের একটু বয়স্ক অনেক সদস্যই সেই ইতিহাসের মধ্য নিজেদের খুঁজে পাবেন । তাদের অভিজ্ঞতাই চারিয়ে যাবে বর্তমানে ।
প্রশ্নটা, তারপরেও থেকে যায়, কেন পড়বো এত ইতিহাস ? কেন জানবো পুরানো দিনের কথা ? একটা গল্প বলা যাক । একদিন একটা রেল স্টেশনে দু-জন ব্যক্তির দেখা হল । হঠাৎই । ট্রেন দেরি করেছিল আসতে তাই কথা বলছিলেন তারা । কথা বলতে বলতে এক সময়ে জানা গেল তারা দু-জন একই পরিবারের মানুষ। তাদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক আছে । কিন্তু অনেকদিন আগে দুটো পরিবার আলাদা হয়ে গিয়েছিল। আর কোন যোগাযোগ ছিল না পরিবার দুটোর মধ্যে । আজ আর তাই তারা একে অন্যকে আপনজন বলে চিনতে পারেননি । গল্পটা যদি বাস্তব করে নেওয়া হয় ? স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রতিবেশী স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দু রাষ্ট্র এক সময়ে ভারতবর্ষেরই আত্মীয় ছিল । দীর্ঘদিন তারা পাশাপাশি ছিল । অথচ একসময় তারা আলাদা হয়ে গেল । তারপর সময় সঙ্গে সঙ্গে আত্মীয়তার বাধন গেল আলাদা হয়ে । আজ তারা একে অন্যকে আত্মীয় বলে চিনতে পারেনা । নিজের ফলে আশা আত্মীয়তাকে নতুন করে চিনে নেওয়ার জন্য ইতিহাস পড়তে হয়। কেমন করে আত্মীয়রা আলাদা হয়ে গেল, তা বুঝতে হলে ইতিহাস করতে হবে ।
উপরের ফটোগ্রাফটি দেশভাগের যন্ত্রণা ও নতুন ঠাই খোঁজার সংশয়দির্ণ মানুষের ছবি । ছবিতে ( পুরুষ ও নারী ) চোখের ভঙ্গি থেকেই তাদের উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশ পাচ্ছে ।
ওপরের ফটোগ্রাফটি বোম্বাইয়ের একটি ব্রাহ্মণ পরিবারের । ছবিতে ব্যক্তিদের (পুরুষ ও নারী) পোশাক, দাঁড়ানোর/ বসার ভঙ্গি প্রভৃতি থেকে যাদের ছবি তোলা হচ্ছে, তাদের মনোভাব, সামাজিক-সংস্কৃতিক অবস্থান প্রভৃতি বোঝা যায় । অতএব সামাজিক-সংস্কৃতিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে ফটোগ্রাফ এর গুরুত্ব অপরিসীম ।